গানটির সারমর্ম লিখি
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
গৌতম বুদ্ধ জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব প্রাণী ও মানুষের কল্যাণে তাঁর ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তাঁর শিক্ষার মূল বাণী হলো মৈত্রী, করুণা, শান্তি ও সম্প্রীতি। তিনি কেবল মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেননি, বিশ্বব্রহ্মান্ডের সব সত্তার মঙ্গলের জন্য চিন্তা করেছিলেন। সব সত্তার প্রতি তিনি মৈত্রীভাব পোষণ করতে বলেছেন। তাঁর মৈত্রী করুণা অসীম, কোনো সাম্প্রদায়িক সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ নয়। মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা সর্বজনীনভাবে আড়াই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে সারা বিশ্বে শান্তি, মানবতা ও আধ্যাত্মিকতা বিকাশের ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বৌদ্ধধর্মের এ সর্বজনীন অবদানকে স্মরণ করে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্বলাভ, পরিনির্বাণ লাভ এ ত্রিস্মৃতি বিজড়িত দিবসকে 'বৈশাখ দিবস' (Vesak Day) হিসেবে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কারণ, বুদ্ধের শিক্ষা জাতিসংঘ সনদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বর্তমান সংঘাতময় বিশ্বে গৌতম বুদ্ধের সহনশীলতা, সম্প্রীতি, শান্তি ও করুণার সর্বজনীন বার্তা খুবই প্রাসঙ্গিক।
বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি ভারতবর্ষে। কিন্তু এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন: শ্রীলংকা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, তিব্বত, চীন, জাপান, মঙ্গোলিয়া, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল, বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু অংশে বৌদ্ধধর্ম অনুসরণ করা হয়। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী।
বুদ্ধ মানবজীবনের সমস্যাবলি নিয়ে চিন্তা করেছেন, সমাধানের উপায়ও বলে দিয়েছেন। বুদ্ধের শিক্ষামতে, নৈতিক জীবন গঠন করে সুখী জীবন যাপন করা এবং অন্তিমে নৈতিক উৎকর্ষ সাধন করে নির্বাণ অর্জনের মাধ্যমে চরম দুঃখের অবসান করা সম্ভব। ইহজীবনে সুখী জীবন ও অন্তিমে পরম সুখ নির্বাণ অর্জন করার এ প্রক্রিয়ায় তিনি তিনটি অনুশীলনের শিক্ষা দিয়েছেন। যথা- শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা।
শীল হলো নৈতিকতার অনুশীলন। পুণ্য অর্জন ও ভালো আচরণ করা এবং নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণ করা। এ শিক্ষা দুটো মূল নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত: সমতা- সকল জীব সমান; এবং পারস্পরিকতা – নিজে অন্যের কাছ থেকে যেমন আচরণ প্রত্যাশা করি, সবার সঙ্গে তেমনি আচরণ করা। কারোর কাছে ভালো আচরণ প্রত্যাশা করলে, নিজেকেও তার সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে।
সমাধি হলো মনের অনুশীলন। এর অর্থ হলো একাগ্রতা, ধ্যান ও মনের উৎকর্ষ সাধন। মনের উন্নতি সাধিত হলে প্রজ্ঞা হয় এবং প্রজ্ঞা উৎপন্ন হলে বিমুক্তির পথ সুগম হয়। মানসিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে মনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর ফলে আচরণ বা শীল পরিশীলিত হয়।
প্রজ্ঞা হলো দূরদৃষ্টি ও অন্তর্দর্শন, অর্থাৎ মানসিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান লাভ করা। প্রজ্ঞা হলো বৌদ্ধধর্মের সার অংশ। দেহ ও মন পূত-পবিত্র ও প্রশান্ত হলে প্রজ্ঞার উৎপত্তি হয়।
বুদ্ধের শিক্ষামতে, এ তিনটি অনুশীলনের মধ্যে প্রজ্ঞা অনুশীলনকে সবচেয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞা অনুশীলনের মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সকল মানুষ প্রকৃত সুখ লাভ করতে পারে। এটা সর্বজনীন শিক্ষা।
বুদ্ধের শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মুক্তচিন্তা। তিনি তাঁর ধর্মকে অন্ধভাবে অনুসরণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। উপদেশ দিয়েছেন ভালো-মন্দ যাচাই করে তাঁর শিক্ষা গ্রহণের। পরস্পরের প্রতি মৈত্রী-করুণা পোষণ করা এবং প্রতিনিয়ত আত্ম-উন্নতি করার উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'নিজের মুক্তি নিজেকেই অর্জন করতে হবে, আমি শুধু পথ দেখাতে পারি।' বুদ্ধের শিক্ষার তিনটি মৌলিক অঙ্গ হলো:
১. তিনটি সর্বজনীন সত্য;
২. চতুরার্য সত্য;
৩. আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ।
তিনটি সর্বজনীন সত্য
১. পৃথিবীতে কোনো কিছু স্থায়ী নয়, প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল;
২. যা পরিবর্তনশীল বা অনিত্য, তা দুঃখের জন্ম দেয়;
৩. অনাত্মা অর্থাৎ আত্মা বলতে কিছু নেই।
চতুরার্য সত্য:
দুঃখের কারণ অন্বেষণ করতে গিয়ে বুদ্ধ চতুরার্য সত্য আবিষ্কার করেছেন। চারটি সত্য হলো-
১. দুঃখ সত্য: জগতে দুঃখ আছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই দুঃখের অধীন। জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মৃত্যু দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ, প্রিয় বিচ্ছেদ দুঃখ, কাঙ্ক্ষিত জিনিসের অপ্রাপ্তি দুঃখ এবং পঞ্চস্কন্ধময় এ দেহ দুঃখ হতে পৃথিবীতে কেউ মুক্ত নয়। জন্মজন্মান্তরে সব জীব এসব দুঃখ ভোগ করে আসছে;
২. দুঃখের মূল কারণ হলো কামনা বা তৃষ্ণা। তিন ধরনের তৃষ্ণা দুঃখ তৈরি করে। যেমন: কাম তৃষ্ণা (যেমন: অতি ভোগ স্পৃহা); ভব তৃষ্ণা (যেমন: নাম, যশ, প্রভাব-প্রতিপত্তি পাওয়ার ইচ্ছা) এবং বিভব তৃষ্ণা (যেমন: জীবনে অপ্রীতিকর কোনো কিছুর মুখোমুখি না হওয়ার আকাঙ্ক্ষা; যেমন: বিপদ থেকে মুক্ত থাকার ইচ্ছা);
৩. দুঃখের নিরোধ আছে। কামনা বা তৃষ্ণা নিবৃত্তির মাধ্যমে চরম দুঃখমুক্তি নির্বাণলাভ সম্ভব হয়;
৪. দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথও আছে। এ দুঃখমুক্তির পথ হলো আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। মার্গ মানে পথ। দুঃখমুক্তির পথ হিসেবে বুদ্ধ আটটি পথ বা নিয়মা অনুসরণ করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ
মানুষ জন্মজন্মান্তরে বিভিন্ন কামনা-বাসনার কারণে দুঃখ ভোগ করে। বুদ্ধ এসব দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের জন্য খুব সহজভাবে আটটি পথ অনুসরণ করার উপদেশ দিয়েছেন। সেগুলো হলো ১. সৎ বাক্য, ২. সৎ কর্ম, ৩. সৎ জীবন বা জীবিকা, ৪. সৎ চেষ্টা, ৫. সৎ চিন্তা, ৬. সৎ চেতনা, ৭. সৎ সংকল্প ও ৮. সৎ দৃষ্টি বা সমাধি।
উল্লেখিত প্রথম তিনটি পথ অনুসরণ করে মানুষ তার দেহকে রক্ষা করে। সৎ চেষ্টা, সৎ চিন্তা ও সৎ চেতনার মাধ্যমে মানুষ তার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সৎ সংকল্প ও সৎ দৃষ্টি বা সমাধির মাধ্যমে প্রজ্ঞা বা বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ লাভ করতে পারে। এর ফলে দুঃখমুক্তি লাভ সহজ হয়।
পাঁচটি শিক্ষানীতি
বুদ্ধ সকল মানুষের পরম সুখ লাভের উপায় হিসেবে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন প্রজ্ঞার ওপর। সেটি অনুশীলন করতে কঠোর ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীদের পক্ষে এটা করা সহজ; কিন্তু সাধারণ গৃহীদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হতে পারে। সে কারণে বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছেন, কেবল পাঁচটি নীতি (যা পঞ্চশীল হিসেবে পরিচিত) অনুসরণ করলেও ইহজীবনে ব্যক্তি জীবন ও সমাজ-জীবন সুখের হয়। সে পাঁচটি নীতি বা শিক্ষা হলো-
১. কাউকে হত্যা করা বা ক্ষতি করা বা জীবিত প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ থেকে বিরত থাকা। একই সঙ্গে নিজের জীবনে মৈত্রী ও করুণা চর্চা করা;
২. চুরি না করা। সবার সঙ্গে পারস্পরিক সততা ও শ্রদ্ধাবোধ অনুশীলন করা এবং অন্যের সহায়-সম্পত্তির মালিকানা ও অধিকারের প্রতি সম্মান করা এবং সততা অনুশীলন করা;
৩. ব্যভিচার না করা বা নর-নারীদের মধ্যে অসদাচারণ না করা; জীবনে সম্মান, আন্তরিকতা ও সততার অনুশীলন করা;
৪. মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকা; জীবনে সত্যবাদিতা অনুশীলন করা; এবং
৫. ক্ষতিকর পানীয় ও মাদকাসক্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখা; ভাবনা বা ধ্যানের মাধ্যমে জীবনে মননশীলতা চর্চা ও সচেতনতা তৈরি করা।
কেবল এ পাঁচটি নীতি অনুসরণ করেও নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়। এতে ব্যক্তিজীবন যেমন উন্নত হয়, তেমনি সমাজেরও অনেক উন্নতি হয়। সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শান্তি ও সুসম্পর্ক তৈরি হয়। এ পাঁচটি নীতির উপকারিতা সম্পর্কে বুদ্ধ বলেছেন, "অভযং দেতি, অবেরং দেতি, অব্যাপজ্জং দেতি"। অর্থাৎ পঞ্চশীল পালনের মাধ্যমে সমাজের মানুষ ভয়, হিংসা এবং মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকে। যেমন: হত্যা ও মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকলে সমাজে সহিংসতা থাকে না; অন্যের জিনিস চুরি না করলে সমাজের মানুষের সম্পত্তির সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়; ব্যাভিচার না থাকলে পারিবারিক মূল্যবোধ ও শান্তি সুদৃঢ় হয়। সমাজের মানুষ মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকলে সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ভালো হয়, তাদের মধ্যে আস্থা ও সুসম্পর্ক তৈরি হয়। সামাজিক পরিবেশ উন্নত হয়। বুদ্ধের শিক্ষামতে, কেবল এ পাঁচটি নীতি অনুসরণ করলেও যেকোনো সমাজে সুখ, শান্তি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব।
মানুষের জীবনে সুষ্ঠু ও সার্থক জীবন গড়ে তোলার জন্য বুদ্ধ মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা গুণের কথা বলেছেন। এ চারটি গুণকে একত্রে ব্রহ্মবিহার বলা হয়। ব্রহ্ম ও বিহার দুটি শব্দ মিলে ব্রহ্মবিহার শব্দটি গঠিত হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে 'ব্রহ্ম' হলো শ্রেষ্ঠ দেবসত্তা, যিনি ধ্যান সাধনার মাধ্যমে পরিপূর্ণতা অর্জন করে ব্রহ্মলোকে জন্মগ্রহণ করেন; আর 'বিহার' অর্থ 'আবাস'। বৌদ্ধধর্মমতে, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা- এ চার ব্রহ্মবিহার নীতি চর্চা করে এমন অপরিমেয় পরিশুদ্ধতা অর্জন করা যায়, যা যেকোনো মানুষকে মহত্তম ও দেবতুল্য করে তোলে; অর্থাৎ ব্রহ্মার মতো হন। ব্রহ্মবিহারী মানুষের মধ্যে সব সময় সকল জীবের প্রতি দয়া ও বিপদগ্রস্তদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে সক্রিয় প্রচেষ্টা থাকে; তিনি অন্যের সুখে সুখী হন এবং তিনি লাভ- অলাভ, নিন্দা-প্রশংসা, সাফল্য-ব্যর্থতা ও সুখ-দুঃখের মধ্যেও মানসিকভাবে স্থির থাকেন। এজন্য ব্যক্তিজীবনে পরিশুদ্ধতা অর্জন করতে এবং সমাজে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ব্রহ্মবিহার নীতির গুরুত্ব অনেক। এগুলো ব্যক্তি জীবনের আধ্যাত্মিকতা অর্জনের ভিত্তি, তেমনি সমাজের মানুষের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্বভাব ও সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠারও ভিত্তি।
মেত্তার বাংলা সমার্থক শব্দ মৈত্রী। মৈত্রী শব্দের অনেক অর্থ আছে। যেমন: সর্বজনীন প্রেম, দয়া, বন্ধুতা, শুভকামনা, উপকারিতা, সহভাগিতা, সৌহার্দ্য, মিলন, অনাক্রম ও অহিংসা। মৈত্রীর মূল অর্থ হলো, সবার জন্য কল্যাণ ও সুখ কামনা (পালিতে পরহিত-পরসুখ কামনা)। কারোর মনে যখন মৈত্রী জন্মে, তখন সে কখনো কাউকে ক্ষতি করতে পারে না, কারোর বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা রাগ থাকে না। মৈত্রীর মাধ্যমে অসীম প্রেম, সহমর্মিতা, সহভাগিতা, বন্ধুতা তৈরি হয় বলে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সামাজিক, ধর্মীয়, জাতিগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাধা সমাধান করা সম্ভব হয়। সে কারণে মৈত্রী হলো নিঃস্বার্থ ও সর্বজনীন ভালোবাসা।
বুদ্ধ বলেছেন, মা যেমন একমাত্র পুত্রকে নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করেন, তেমনি সকল প্রাণীর প্রতি অপরিমেয় মৈত্রীভাব পোষণ করতো। নিদ্রার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত দাঁড়ানো অবস্থায়, চলমান অবস্থায়, বসা বা শোয়া অবস্থায় মৈত্রী চিন্তা করতে হবে। অর্থাৎ সব সময় মৈত্রীভাব বজায় রাখতে হবে। এ মৈত্রী শুধু মানুষের প্রতি নয়, সকল জীবের প্রতি পোষণ করতে হবে। ছোট-বড়, দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান, যারা জন্মেছে বা ভবিষ্যতে জন্মাবে, সকল জীবের প্রতি মঙ্গল কামনা করতে বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছেন। মানুষ পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। আপদে- বিপদে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হয়। সে কারণে শুধু পারিবারিক বন্ধন নয়, সমাজের সব মানুষের মধ্যে বন্ধন সুদৃঢ় হতে হবে। কারো মনে যদি হিংসা-বিদ্বেষ থাকে, ঝগড়াটে হয়, তাহলে সে বিপদের সময় কারো সহযোগিতা পাবে না। সে কারণে বুদ্ধ রাগ, ঘৃণা, বিদ্বেষ দূর করে সবার প্রতি মৈত্রীভাব গড়ে তুলতে উপদেশ দিয়েছেন। মৈত্রীভাবে দুই ভাগে গড়ে তোলা যায়: ১. কুশল কর্ম চর্চার মাধ্যমে। যেমন: কারো সঙ্গে খারাপ কথা না বলা, সবার সঙ্গে বন্ধুত্বভাব বজায় রাখা ইত্যাদি: ২. মৈত্রী ভাবনার মাধ্যমে। সবার সুখ কামনা করা। মৈত্রী ভাবনার মাধ্যমে মানুষের চিত্ত শান্ত ও সমাহিত হয়; কায়িক আচরণ, বাক্য ও মন সংযত হয়। এতে শত্রুভাব দূর হয়। কোনো নিন্দনীয় কাজ না করা, অল্প লাভে সন্তুষ্ট থাকা এবং বিদ্বেষ বা রাগবশত কারো দুঃখ কামনা না করা। এভাবে মৈত্রী ভাবনাকারী ব্যক্তির তৃষ্ণা নিরোধ হয় এবং অন্তিমে পুনর্জন্ম রোধ করে নির্বাণ লাভ করতে সক্ষম হন।
করুণা অর্থ হলো করুণা ভাবনার দ্বারা মানুষ ও সব সত্তার প্রতি নিঃস্বার্থভাবে দয়া পোষণ করা এবং তাদের দুঃখ নিরসনের জন্য চিন্তা করা, তাদের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত করার জন্য সংকল্প করা। করুণা একটি সক্রিয় কাজ, যেমন: ক) কোনো ব্যক্তি যদি কোনো দুর্দশার মধ্যে থাকে, তাকে দেখে কারো যদি দয়া উদয় হয়, তাহলে তিনি সক্রিয়ভাবে ঐ ব্যক্তির দুর্দশা দূর করার জন্য সাহায্য করেন; খ) কারো মনে যখন করুণা তৈরি হয়, তখন তিনি অন্য কারো দুঃখ সহ্য করতে পারেন না; তিনি তাকে সাহায্য করেন; ও গ) কারো ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা হলো করুণার বহিঃপ্রকাশ এবং কাউকে ক্ষতি না করার চিন্তা ও শান্তি করুণা অনুশীলনের মাধ্যমে আসে। ভাবনার মাধ্যমে করুণা তৈরি হয়।
করুণার ধারণাকে একটি উপমার মাধ্যমে সহজভাবে বুঝানো যায়। যেমন: অনেক আগের কথা। এক ব্যক্তি একাকী এক দূর গ্রামে যাওয়ার জন্য বের হলেন। যাত্রার মধ্যপথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, একপর্যায়ে তাঁর চলার শক্তি শেষ হয়ে এলো। তিনি খুবই কষ্টবোধ করছিলেন। কিন্তু তাঁর গন্তব্য গ্রাম আরো অনেক দূরে। সে সময় সেখানে এক লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি ঐ অসুস্থ পথচারীকে দেখতে পেলেন। অসুস্থ পথচারীকে দেখে তিনি মনে মনে ভাবলেন, যদি তাঁকে সেবা দেওয়া যায়, বন থেকে নিয়ে গিয়ে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া যায়, তাঁকে ওষুধ ও ভালো পথ্য খাওয়ানো যায়, তাহলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারবেন।
এ উপমায় দ্বিতীয় ব্যক্তির করুণার পরিচয় পাওয়া যায়। অসুস্থ পথচারীর প্রতি তাঁর মনে করুণা, সমব্যথা ও দয়া উৎপন্ন হয়েছে। এভাবে অন্যের দুঃখ-দুর্দশা দূর করাই হলো করুণা।
এ ভাবনার মাধ্যমে ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতা ত্যাগ করে অন্যের সুখ ও সাফল্যে সুখ অনুভব করা। যেমন: কোনো শিক্ষার্থী যদি খুব পরিশ্রম করে ভালো ফল অর্জন করে এবং পুরস্কার লাভ করে, তার সাফল্যে খুশি হওয়া। সে ভবিষ্যতে যাতে আরো উন্নতি করতে পারে, তাকে উৎসাহ দেওয়া ও সহযোগিতা করা।
কেউ কেউ অন্যের সাফল্যে ঈর্ষা পোষণ করে। অন্যের সফলতা কামনা করতে পারে না। মনের মধ্যে এক কুচিন্তা তৈরি করে। এ রকম কুচিন্তা থেকে তারা অন্যের দুঃখ-দুর্দশা সৃষ্টি করে। এরকম ঈর্ষার বিপরীত অবস্থা হলো মুদিতা। যাঁর মধ্যে মুদিতা জন্মে, তিনি কখনো কারো প্রতি ঈর্ষা করেন না, অন্য কেউ সাফল্য অর্জন করলে খুশি হন। অন্য কেউ ধন সম্পদ অর্জন, কোনো কাজে ভালো ফল ও নাম-যশ অর্জন করলে তিনি প্রশংসা করেন। এভাবে মুদিতা সমাজে ভালো কাজ করা; জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ইত্যাদিকে উৎসাহিত করে। মুদিতা অনুশীলন বিভিন্নভাবে করা যায়। যেমন: ক) অন্যের সফলতায় আনন্দ উদ্যাপন করা; খ) অন্যের সাফল্যে মনের মধ্যে হিংসা না আনা; ও গ) মনের ভেতর থেকে বিদ্বেষভাব দূর করা।
রাগ, ভয়, মোহ ও পক্ষপাতমুক্ত হয়ে সবকিছুতে নিরাসক্ত হয়ে সমদৃষ্টিতে দেখাই হলো উপেক্ষা ভাবনা। আমরা যদি চারদিকে দেখি এবং নিজের ভেতরকে দেখি, তখন বুঝা যায় নিজের মনের মধ্যে সমতা বজায় রাখা কতটা কঠিন। মানুষের জীবনে অনেক উত্থান-পতন থাকে, সাফল্য ব্যর্থতা থাকে। রাত-দিনের মতো মানুষের জীবনে নানা বৈপরীত্য থাকে। যেমন: সুখ-দুঃখ, সাফল্য-ব্যর্থতা, লাভ-অলাভ, নিন্দা-প্রশংসা ইত্যাদি মানুষের জীবনের অংশ। এসব লোকধর্মে মানুষ সহজে উদ্বেলিত কিংবা বিচলিত হয়। যখন ভালো কিছু হয়, তখন সে খুশিতে খুবই উল্লসিত হয়; আর যখন দুঃখ আসে, তখন খুবই বিচলিত হয়। আশা, হতাশা মানুষের খুবই সাধারণ ব্যাপার। এসব হলো আবেগ। মানুষ আবেগে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মনের শান্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলতে পারে। এ অবস্থায় আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং তা সুচিন্তিতভাবে। এজন্য নিজের মনের ওপর সজাগ দৃষ্টি রেখে সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, নিন্দা-প্রশংসা অর্থাৎ জীবনের নানা উত্থান-পতনের মধ্যে নিজেকে স্থির রাখা জরুরি। এটাই হলো উপেক্ষা।
বুদ্ধের সময়ে ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মধ্যে ভেদাভেদ ছিল। বুদ্ধ জাতিভেদ, ধর্ম ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য, শুদ্র, চন্ডাল সবাই মানুষ। মানুষ হিসেবে সবাই সমান। জাতি বা বর্ণভিত্তিক পরিচিতি মানুষের প্রকৃত পরিচয় হতে পারে না, সেটি মানুষের পরিচিতির সাধারণ একটা নাম মাত্র। পেশাভিত্তিক সাধারণ পরিচিতি থাকতে পারে। যেমন: তৎকালীন ভারতবর্ষে পেশা অনুসারে চতুবর্ণ প্রথা ছিল: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ব্রাহ্মণের কাজ হলো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানাদি করা, ক্ষত্রিয়ের কাজ হলো দেশ রক্ষা করা, বৈশ্যের কাজ হলো কৃষিকাজ ও ব্যবসা করা এবং শূদ্রের কাজ হলো অন্যদের সেবা করা। তখনকার সময়ে শূদ্রদের সবচেয়ে নীচ জাতের মনে করা হতো। তারা অস্পৃশ্য ছিল। তাদেরকে বিভিন্নভাবে হেয় করা হতো। রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, উঁচু-নীচ এমন কোনো ভেদাভেদ বুদ্ধ মানেননি। বুদ্ধ রাজা শ্রেষ্ঠীদের আমন্ত্রণ যেমন গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি সে সময়ের সমাজের তথাকথিত অস্পৃশ্য মানুষের বাড়িতে গিয়েও অন্ন গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সর্বশেষ আহার গ্রহণ করেছিলেন কর্মকার চুন্দর বাড়িতে। জাতি- ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে তিনি সবাইকে স্থান দিয়েছিলেন। বৌদ্ধ ইতিহাসে আম্রপালী নামে এক গণিকার কথা আছে। তিনি সমাজের চোখে ঘৃণ্য ও অস্পৃশ্য ছিলেন। ধনাঢ্য ব্যক্তি ও সমাজপতিদের আপত্তি সত্ত্বেও বুদ্ধ অস্পৃশ্য আম্রপালীর বাড়ি গিয়ে আহার গ্রহণ করেছিলেন। বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছিলেন, পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা করো; মানুষ মানুষ হয়ে জন্মায়, পাপী হয়ে নয়। সমাজ ও পরিস্থিতি তাকে খারাপ বানায়। বুদ্ধ সারা জীবন মানুষকে ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে সৎ, সুখী ও শান্তিপূর্ণ জীবন শিক্ষা দিয়েছিলেন। বুদ্ধ কখনো অন্য ধর্মকে কিংবা অন্য ধর্মের লোককে অবজ্ঞা করেননি। তাঁর শিষ্যদের কখনো তাঁর ধর্মে ধর্মান্তরিত করার অনুমতি দেননি। তাঁর শিক্ষার একটাই উদ্দেশ্য জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষকে ন্যায়নিষ্ঠ, মহান ও ধর্মসম্মত জীবনব্যবস্থায় গড়ে তোলা।
গৌতম বুদ্ধের সাম্যবাদ ও মানবতাবাদের আদর্শে অনেক মহান ব্যক্তি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম। তিনি তাঁর বিভিন্ন নাটক ও কবিতায় বুদ্ধের মানবতাবাদ ও সাম্যবাদের লড়াইকে সমর্থন করেছিলেন। কবি গুরুর এমন একটি নাটক 'চণ্ডালিকা'। এ নাটকে তিনি জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে বুদ্ধের অবস্থানকে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছিলেন। বুদ্ধের শিষ্য আনন্দ এক অস্পৃশ্য চন্ডালকন্যার কাছে পিপাসার্ত হয়ে জল চেয়েছিলেন। তখন চণ্ডালকন্যা বিব্রত হয়ে ভিক্ষু আনন্দকে জল দিতে চায়নি। কারণ, সে নিজেকে অস্পৃশ্য মনে করে। অস্পৃশ্য কারোর কাছ থেকে জলপান পাপ হবে। তখন চণ্ডালিকা ভিক্ষু আনন্দকে বলছিল, 'প্রভু, আমি চণ্ডালের মেয়ে, কুয়োর জল অশুদ্ধ।' এর উত্তরে আনন্দ চণ্ডালিকাকে বললেন, 'কে বলে তুমি অস্পৃশ্য?' তাকে আরো বললেন 'যে মানুষ আমি, তুমিও সেই মানুষ, সব জলই তীর্থজল, যা তাপিতকে স্নিগ্ধ করে, তৃপ্ত করে তৃষিতকে।' চণ্ডালিকা এরকম কথা কারোর কাছ থেকে কখনো শোনেনি। আনন্দের কথায় সন্তুষ্ট হয়ে সে তাঁকে তেষ্টা নিবারণের জন্য পানি পান করতে দিয়েছিল। এ কাহিনির মাধ্যমেও মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই- সে সত্যই তুলে ধরা হয়েছে।
বৌদ্ধধর্ম অনুসারে, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য নিজের স্বার্থসিদ্ধি করা নয়; বরং অন্যের সেবা করে তাদের দুঃখ লাঘব করাই মহৎ কাজ। এ মহৎ কাজের জন্য মানুষকে অনেক মানবিক গুণ অর্জন করতে হয়। এ মানবিক গুণাবলি নীতি-নৈতিকতা, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক রীতি-নীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। মানবিক গুণাবলির মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনে মানুষ একে অপরের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে। মানুষ প্রাণী, পশুও প্রাণী। পশুর সঙ্গে মানুষের একটা পার্থক্য হলো, মানুষের মন আছে, যেটা পশুর নেই। মন আছে বলে মানুষ চিন্তা করতে পারে; কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে, যেটা পশু পারে না। পশু সহজাত প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয়, কিন্তু মানুষ নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তার আচরণ সংযত করতে পারে। মানুষ তার মনের শক্তিকে উন্নত করতে পারে, নিজেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। সে বুদ্ধত্বলাভের সক্ষমতাও রাখে।
বৌদ্ধধর্মমতে, মানুষ দুটি বিষয় দ্বারা চালিত হয়। যথা- নৈতিক লজ্জা ও নৈতিক ভয়। পালিতে এটাকে বলে হিরি ও অত্তপা। হিরি-অত্তপা মানুষের মানবিক মর্যাদাকে সমুন্নত রাখে। হিরি অর্থ হলো যেকোনো অকুশল কাজ করতে মনে মনে লজ্জা বোধ করা; আর অত্তপা হলো অকুশল কাজ করলে দুঃখ ভোগ করতে হবে, সেই ভয়ে অকুশল কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। হিরি ও অত্তপা না থাকলে মানুষ পশুতে পরিণত হয়। এ দুটি জিনিস না থাকলে মানুষ মাদকাসক্তি, নেশা, লোভ-লালসা, ক্রোধ, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা, ঘৃণা ইত্যাদি খারাপ কাজে জড়িত হয়ে সে পশুর মতো আচরণ করতে পারে। আর যার মধ্যে নৈতিক লজ্জা ও নৈতিক ভয় সব সময় কাজ করে, সে কখনো খারাপ কাজ করতে পারে না। তার মধ্যে অন্যের প্রতি মৈত্রী, করুণা, সহমর্মিতা গড়ে ওঠে, সে অন্যের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। সে সব সময় অন্যের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। সে কারণে মানুষ হিসেবে আমাদের মানবিক গুণাবলি অর্জন করতে হবে। অন্যের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে আমাদের পরস্পরকে জানা, দয়া, করুণা, সততা, সরলতা, ভদ্রতা, নম্রতা ও সন্তুষ্টিবোধ এসব মানবিক মূল্যবোধ অর্জন করতে হবে।
স্বভাবগতভাবে মানুষের তিনটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। যথা- পশুস্বভাব, মনুষ্যস্বভাব ও দেবস্বভাব। এ স্বভাবগুলো প্রত্যেক মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে। যার মধ্যে পশুস্বভাব বেশি কাজ করে, সে তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সে পশুর মতো জঘন্য আচরণ করতেও লজ্জাবোধ করে না। তখন সে সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এ পশুস্বভাব দমনের জন্য ধর্মের অনুশাসন ও অনুশীলন অপরিহার্য। গৌতম বুদ্ধ মানুষকে এ পশুস্বভাব থেকে মুক্ত হতে শীল পালনের উপদেশ দিয়েছেন। গৌতম বুদ্ধের শিক্ষাগুলো ভিক্ষুসংঘ সাধারণ মানুষের কল্যাণে প্রচার করে যাচ্ছেন। গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও পণ্ডিত ভিক্ষুসংঘের দেশিত শিক্ষা অনুসরণ করলে প্রত্যেক মানুষ মানবিক গুণাবলি অর্জন করতে পারবে। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে মানুষ তার মনকে চর্চা ও পরিচর্যা করে তার ভেতরের মনুষ্য স্বভাবকে জাগ্রত করতে পারে। সে যতই তার মনুষ্য স্বভাবকে চর্চা ও পরিচর্যা করতে পারবে, সে ততই তার ভেতরের দেবস্বভাব অর্জন করতে পারবে। কেউ যদি তার দেবস্বভাব অর্জন করতে পারে, তাহলে সে যখন এমন একটা উচ্চপর্যায়ে আসীন হবে, তখন তার মন থেকে লোভ-লালসা, ক্রোধ, হিংসা, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা ও অন্যান্য অকুশল ধর্ম দূরীভূত হয়ে যাবে। সে তখন মানুষ হিসেবে সমাজে মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান লাভ করতে সক্ষম হবে। এভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে মানুষ তার ভেতরের পশুস্বভাবকে দমন করতে পারে। আর মনুষ্য স্বভাবকে চর্চা ও উন্নত করে তার দেবস্বভাব অর্জন করতে সক্ষম হবে।
এ দেবসত্তা অর্জন করার জন্য প্রত্যেককে সর্বজনীন মৈত্রী, অন্যের সেবা করা, করুণা, অন্যের উন্নতিতে সমসুখী হওয়া এবং লাভ-ক্ষতি কিংবা নিন্দা-প্রশংসা শুনে অবিচলিত থাকার গুণাবলি অর্জন করতে হবে। এসব গুণ অর্জন করতে পারলে তাকে কোনো দুঃখ স্পর্শ করতে পারবে না।
মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য বুদ্ধ বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছেন। সেগুলোর একটি হলো ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা: অর্থাৎ মধ্যপথ অনুসরণ করা। মধ্যপথের অর্থ হলো নিজের লক্ষ্য অর্জনে বেশি ভোগ-বিলাসী না হওয়া; একই সঙ্গে নিজের শরীরকেও বেশি কষ্ট না দেওয়া। বুদ্ধের শিক্ষা অনুসারে, মধ্যপথ অনুসরণ করে তিন উপায়ে সুখ লাভ সম্ভব হয়- ইহ জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সুখ অর্জন, পরজন্মে সুখ অর্জন এবং অন্তিমে নির্বাণ সুখ অর্জন। এ তিন ধরনের সুখ অর্জনের মাধ্যমে যে কেউ তার জীবনে মর্যাদা ও মহত্ত্ব লাভ করতে পারে।
বুদ্ধ মানুষের দুঃখমুক্তির জন্য তাঁর শিক্ষা আজীবন প্রচার করে গেছেন। বুদ্ধ বলেছেন, মানুষ মাত্রই দুঃখ ভোগ করে। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই জন্ম, জরা, ব্যাধি, মরণ ও মানসিক অশান্তি, হতাশা, অস্থিরতা ইত্যাদি দুঃখ থেকে মুক্ত নয়। এসব দুঃখ থেকে মুক্ত হতে তিনি শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো ভালো, সুখী ও প্রজ্ঞাবান মানুষ হওয়া। এর জন্য ব্যক্তিগত জীবনে পাঁচটি নীতি অনুসরণ করা। যথা- হত্যা, চুরি, মিথ্যা বলা, নারী-পুরুষের মধ্যে অসদাচার ও মাদকাসক্তি থেকে বিরত থাকা। পঞ্চশীল পালন করলে মানুষের কায়িক ও বাক্য সংযম তৈরি হয়। ভাবনার মাধ্যমে মনোসংযম তৈরি হয়। কায়িক, বাচনিক ও মনো সংযমের মাধ্যমে নিজের জীবন যেমন সুন্দর হয়, তেমনি সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ, সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্ক তৈরি হয়। এতে সমাজে সুখ, শান্তি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জিত হয়।
বুদ্ধ বলেছেন, সমাজের বড় শত্রু হলো লোভ, দ্বেষ ও মোহ (অজ্ঞতা)। এ তিনটি শত্রু থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বুদ্ধ মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা নীতি অনুশীলনের উপদেশ দিয়েছেন। মৈত্রী অনুশীলনের মাধ্যমে সবার জন্য কল্যাণ ও সুখ কামনা করা হয়; দান বা সহযোগিতার মাধ্যমেও মৈত্রী চর্চা হয়। 'সঝে সত্তা সুখিতা ভবস্তু' - জগতে সবাই সুখী হোক এ মৈত্রী ভাবনার মাধ্যমে মানুষসহ সকল জীবের প্রতি কল্যাণ কামনা করা হয়। দ্বেষের প্রতিষেধক হলো করুণা। করুণা চর্চার মাধ্যমে মানুষ পরস্পরের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য সহায়তা করে। মুদিতা অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ নিজের মন থেকে ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতা ত্যাগ করে পরস্পরের সুখ-দুঃখে ভাগীদার হয়। উপেক্ষা নীতি অনুশীলনের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা উৎপন্ন হয়। তখন তার মনে লোভ, দ্বেষ বা কোনো কলুষতা থাকে না। প্রজ্ঞাবান মানুষ যেমন নিজে দুঃখমুক্তি লাভ করেন, তেমনি অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তাকে দুঃখমুক্তির পথ দেখিয়ে দিতে পারেন।
বৌদ্ধধর্মমতে, মানুষ ও পশুর মধ্যে একটা পার্থক্য হলো- মানুষের মন আছে, যেটা পশুর নেই। মন আছে বলে মানুষ চিন্তা করতে পারে, ভালো-মন্দ পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে। মানুষ নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তার আচরণ সংযত করতে পারে। মনের মধ্যে নৈতিক লজ্জা (হিরি) ও নৈতিক ভয় (অত্তপা) থাকলে মানুষ মাদকাসক্তি, নেশা, লোভ-লালসা, ক্রোধ, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা, ঘৃণা ইত্যাদি খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে। পরস্পরের মধ্যে সম্ভাব, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা বজায় থাকে। এতে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হয়।
আরও দেখুন...